– দুর্দৈব থেকে মুক্তি –
ফজলুল আলম
আমাদের জাতীয় জীবনে বর্তমানের যে দুর্দৈব, তার পেছনে আছে আমাদের মূর্খতা। এখানে ‘আমরা’ কিন্তু সবাই নয়, এখানে ‘আমরা’ হচ্ছি সেই দল বা দলসমূহ, যারা জনগণের মুখে ভাষা জোগায়- সে ভাষা কখনো হয় স্বীয় মতের সমর্থনের ভাষা, আবার কখনো হয় বিরুদ্ধ মতকে নাকচ করার জন্য প্রতিবাদের ভাষা। জনগণ সেসব মতকে যাচাই করার খুব একটা সুযোগ পায় না, তারা আমাদের ভাষা পছন্দ হলে সেটারই প্রতিধ্বনি করে। এই ভাষা জোগানোর কাজটা করি ‘আমরা’- রাজনীতিবিদ, জননেতা ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা। আমরা সফলও হই, জনগণ আমাদের জোগানো ভাষা ব্যবহার করে আমাদের অভিসন্ধি বা উদ্দেশ্য পূরণে সহায়তা করে। এটা কিন্তু জনগণের মূর্খতা নয়, এ মূর্খতা ‘আমাদের’। প্লেটো, ম্যাকিয়াভেলি- এমনকি চাণক্য পর্যন্ত যে রাজনীতি বা কূটনীতি বাতলেছিলেন সেসবও আমরা মনে রাখি না, কারণ সেসব পুঁথিগত বিদ্যার পর্যায়ে পড়ে। সেসবে রাজনীতি আর নীতিশাস্ত্রে একটা দ্বন্দ্ব সর্বসময়ে বিরাজমান ছিল; তা সত্ত্বেও কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক উপদেশ যেমন ‘মিথ্যা বললে যদি ভালো হয় তবে মিথ্যা বলা পাপ নয়’, অথবা ‘যুদ্ধে ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নাই’- এসব আপ্তবাক্যে বিশ্বাস রাখা হয়েছে যুগ যুগ ধরে; কিন্তু সেসব আপ্তবাক্য নীতিশাস্ত্রের কঠোর বিধান ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’ অথবা ‘ন্যায়পথে চলিবে’ অগ্রাহ্য করে চলছে।
আমরা জানি, দৈনন্দিন জীবনে আমরা তত্ত্ব নিয়ে চলি না, তত্ত্ব আমাদের অনেকের দৃষ্টিতে বইপুস্তকের ব্যাপার, শ্রেফ পুঁথিগত বিদ্যার পরাকাষ্ঠা। তত্ত্ব কী সেটা পণ্ডিতরা নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন। তার পরও সেসব খুব একটা সহজবোধ্য হয়েছে বলে মনে হয় না। সহজবোধ্য করে না বোঝাতে পারার কারণ ব্যাখ্যাও সহজ নয়। তাতেও বিতর্ক আছে। বোঝা যাক বা না যাক বাস্তব অবস্থার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ছাড়া বড় সমস্যার পূর্ণ সমাধান প্রায় অসম্ভব। তবে কোনো বিষয়ের তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট না জেনেও যেকোনো অবস্থা বোঝার অন্য পদ্ধতি থাকতে পারে। কী হতে পারে সে পদ্ধতি, যা দিয়ে আমাদের বাস্তব জীবনের জটিল সমস্যা সমাধানের দিকে এগোনো যায়?
আমার মতে তত্ত্বের অভাব পূরণ করা যায় দর্শন ও সামগ্রিকতার উপলব্ধি দিয়ে। উদাহরণ আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস। এই ইতিহাসে একটা দর্শন ছিল এবং তাতে সামগ্রিকতার সুস্পষ্ট বোধগম্যতা ছিল। দর্শন ছিল যে এই ভূখণ্ডের জনগণের জীবন কী হবে, এখানকার অর্থায়ন কিভাবে হবে, এখানে কে শাসন করবে- সেসবই আমাদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হবে। অন্য কোনো শক্তি, বিশেষত হাজার মাইল দূরের ভিন্ন সংস্কৃতির দাপটপূর্ণ মানুষের অত্যাচারে আমরা টলব না। এ দর্শনের ভিত্তিতে উচ্চারিত হয়েছিল, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব’। সামগ্রিকতা ছিল এ দেশের ইতিহাসের ঘটনাবলিতে গাঁথা। এই সামগ্রিকতা ছিল বাংলার জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-প্রজ্ঞার একাত্মতাবোধে ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়, সেটার প্রকাশ হয়েছিল ‘এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, …’ এই বক্তব্যে। সাধারণ জনগণ সেই দর্শন ও সামগ্রিকতা সহজেই বুঝতে পেরে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
বিজ্ঞ পাঠককে বলার প্রয়োজন নেই যে একটি জাতির পক্ষ নিয়ে এত নির্ভীক উক্তি দেওয়ার ক্ষমতা তাঁরই ছিল যিনি তৎকালীন বাস্তবতার নিরিখে সামগ্রিকতা বুঝতে পারতেন এবং সেটা সরল ভাষায় প্রকাশ করতে পারতেন।
২.
চলমান সময়ের সংকট নিয়ে সর্বত্র লেখালেখি হচ্ছে, কথাবার্তা হচ্ছে কিন্তু সংকট নিরসনে সবার মতামতই দলীয় পক্ষ নিচ্ছে। দেশের পক্ষে কোনোটাই যাচ্ছে না। এই বিভ্রান্তির কারণ হলো আমরা পরিস্থিতির সামগ্রিকতা বিচারে ব্যর্থ হয়েছি। এই রচনা যখন লিখছি তার কিছু আগে বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসের সুদীর্ঘ মশাল মিছিল বের হয়েছে, সকালে হাজার হাজার মানুষ বধ্যভূমিতে গিয়ে নীরবে শোক প্রকাশ করেছে; এই রচনা প্রকাশের এক দিন আগে পালিত হয়েছে বিজয় দিবস- এসব কর্মকাণ্ডে এ দেশের জনগণের সামগ্রিকতার উপলব্ধি প্রকাশ পায়; কিন্তু সংকট নিরসনে যা প্রয়োজন তা এতে নেই। নির্বাচনভিত্তিক সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিহাস সেখানেই। যেকোনো দল নিজেদের সুবিধার্থে এই গণতন্ত্রকে বানচাল করে দিতে পারে। তাদের কাজের পেছনে আছে আমাদের সামগ্রিকতা বিচারের অক্ষমতা। এই সামগ্রিকতার বিচারে ব্যর্থতার জন্যই আমরা ১৯৭১ সালে একবার লক্ষ লক্ষ জীবন নিহত হতে দেখেছি, ১৯৭৫ সালে পাকিস্তানের ভূত আরেকবার আমাদের মাথায় চড়েছে এবং এখনো সেই ভূত চেপে বসে আছে। এই স্বাধীন-সার্বভৌম দেশটি বিশ্বের দরবারে সম্মানিত হয়েছে শত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে। তার পরও একে অকার্যকর তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র চলছে।
৩.
এ মুহূর্তের সামগ্রিকতা হলো বাংলাদেশের বিপন্ন অস্তিত্ব ও এটা কী ধরনের রাষ্ট্র হবে সেই প্রশ্ন। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে নীলফামারীতে ‘কমান্ডো’ স্টাইলে আক্রমণ কিসের আলামত? সেটা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, বালুতে গলা পর্যন্ত ঢুকিয়ে গণতন্ত্রের আশায় অপেক্ষা করার দিন শেষ। এবার আবার ‘আমাদের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে জেগে উঠতে হবে। বাংলাদেশকে বাঁচাতে ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে, মানবতাকে রক্ষা করতে হলে অস্ত্র হাতে নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। সেটাই হতে হবে এ সময়ের দর্শন ও সামগ্রিকতার বিচার। এখন আমরা সেই সংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন নেতা চাই, একটি দল চাই।